একুশের সম্মুখীন আমরা

প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের সামনে এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি; বা বলা যেতে পারে, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির সম্মুখীন। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার স্মারক একুশে ফেব্রুয়ারি—এই ধারণাটির মধ্যে একটি মজার বিষয় আছে। এর পেছনে প্রশ্ন হলো, কেন এই দিনটি ৮ ফাল্গুনে নয়? আসলে, বাংলাদেশ ও বৃহত্তর ভারতসহ এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার বেশি পরিচিত এবং ব্যবহৃত, ফলে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এই মাসগুলো বাংলায় আত্তীকৃত হয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় এটি স্বাভাবিক। বাঙালি জাতীয়তাবোধের উদাহরণ একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক উদযাপন, যা এই দৃষ্টিকোণ থেকে উদার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদকেই তুলে ধরে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। তবুও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা করেন। কিন্তু বাঙালি তখনো বাংলাকে পাকিস্তানের ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে চেয়েছিল, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করেছে, তা অন্য জাতির বিরুদ্ধে নয়, বরং এক উদার গণতান্ত্রিক জাতির পক্ষ থেকে।
বেশ কিছু সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে ‘বৈষম্য’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবং রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো সকলেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিল। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনও সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল, যা দেশের সব আন্দোলনের অংশ।
বর্তমানে দেশের সরকার কিছু বৈষম্য নিরোধ ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে শিক্ষানীতি ও ভাষানীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। একুশের মূল উদ্দেশ্য ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, কিন্তু এখনও আমরা এই লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারিনি। শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত, যেখানে অনেক স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয় এবং মাদ্রাসাগুলোতে আরবি ভাষার পুস্তক ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাদানও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলায় হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশ্বমানের পাঠ্যপুস্তক রচনা প্রয়োজন। ইংরেজি বা অন্য ভাষার জ্ঞানের সাথে মাতৃভাষার মিশ্রণ দিয়ে এই কাজ সম্ভব হতে পারে। তবে সমাজে এখনও বাংলা ভাষার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা ছিল, তা এখন অনেক কমে গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা আমাদের জন্য একটি নতুন দায়িত্ব তৈরি করেছে: তা হলো বাংলার পাশাপাশি বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাগুলোকেও সম্মান দেওয়া এবং সেসব ভাষায় শিক্ষাদান ব্যবস্থা করা।
এভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না হলে বৈষম্য দূর হবে না এবং সমাজে বিভাজন বেড়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন