রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ভয়াবহ অভিযোগ, নীরব ভারত সরকার

ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫, ৪:৩৮ অপরাহ্ণ
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ভয়াবহ অভিযোগ, নীরব ভারত সরকার

৮ মে সন্ধ্যায় দিল্লির এক তরুণ রোহিঙ্গা শরণার্থী একটি ফোনকল পান, যেটি ছিল মিয়ানমার থেকে। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন তার বাবা-মা, যারা জানালেন—তাদের সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এর মাত্র দুই দিন আগে তিনি দেখেছিলেন, পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে তার বাবা-মাসহ আরও ৪১ জনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর ফোনে তার বাবা-মা এক নির্মম অভিজ্ঞতার কথা জানান, যেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আন্দামান সাগরে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে নামিয়ে দিয়ে কেবল লাইফ জ্যাকেট হাতে দিয়ে সাঁতরে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে পৌঁছাতে বাধ্য করে। উপকূলে পৌঁছে তারা এক জেলের ফোন থেকে ছেলেকে কল করেন। ছেলেটি জানায়, তার বাবা-মা আশঙ্কা করছিলেন—মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের যেকোনো সময় ধরে নিয়ে যেতে পারে।

তবে ভাগ্যক্রমে, তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে পড়েননি; বরং ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নির্বাসিত অবস্থায় থাকা ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ (এনইউজি)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন এক এলাকায় পৌঁছান। এনইউজি জানিয়েছে, তাদের সশস্ত্র শাখা ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’-এর হেফাজতে বর্তমানে ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এনইউজি সরকারের মানবাধিকার উপমন্ত্রী এবং সরকারের একমাত্র রোহিঙ্গা সদস্য আউং কিয়াও মোয়ে জানান, উদ্ধার হওয়া শরণার্থীরা বলেছে, ভারত থেকে তাদের জোরপূর্বক বিতাড়িত করে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, তারা এখন নিরাপদ আছে এবং প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা পাচ্ছে, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

ভারতের সংবাদমাধ্যম স্ক্রোল ফোনকলের রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করে এই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়। এক রেকর্ডিং-এ এক শরণার্থী বলেন, তাদের মারধর করা হয় এবং মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় যে তারা পাহেলগামের সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত ও হিন্দুদের হত্যা করেছে—যার কোনো প্রমাণ নেই। স্ক্রোল এনইউজি প্রদত্ত ৪০ জনের তালিকা এবং দিল্লিতে আটক ৪৩ জনের তালিকা মিলিয়ে দেখে, অন্তত ৩৬ জনের পরিচয় মিলে গেছে। একজন রোহিঙ্গা তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের ছবি দেখে স্বস্তি প্রকাশ করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের বিতাড়ন ভারতের আইন এবং আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন লঙ্ঘন করে। কারণ, এসব শরণার্থী জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এ নথিভুক্ত এবং পরিচয়পত্রধারী ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ এক বিবৃতিতে জানায়, এটি সরাসরি আন্তর্জাতিক এবং ভারতের নিজস্ব আইনের লঙ্ঘন। আউং কিয়াও মোয়ে বলেন, যেখান থেকে তারা গণহত্যা এড়িয়ে পালিয়ে এসেছিল, ভারত আবার সেই নরকে ফেরত পাঠিয়েছে।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি থমাস অ্যান্ড্রুজ এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শরণার্থীদের নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার চিন্তাও অগ্রহণযোগ্য। জাতিসংঘ এই অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে বলে জানান তিনি। এদিকে দিল্লির দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী সুপ্রিমকোর্টে একটি আবেদন দায়ের করেছেন, যাতে এই বিতাড়নের পদ্ধতির তদন্ত এবং তাদের ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

ভারত সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে জানা যায়, ৬ মে দিল্লি পুলিশের অভিযানে মুসলিম ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের বাড়িতে হানা দেওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টে দায়ের করা আবেদনে বলা হয়, ৪৩ জনকে আটক করা হয়েছিল। একজন জানান, তার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় পুলিশ তাকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। আরেকজন বলেন, নারী পুলিশ না থাকা সত্ত্বেও পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তারা নারীদের ধরে নিয়ে যায়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ১৩ জন নারী, ৪ জন প্রবীণ, একজন ক্যান্সার রোগী ও ৯ জন কিশোর-কিশোরী।

৭ মে তাদের ইন্দরলোক ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের বলা হয়, বায়োমেট্রিক নেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরে দেখা যায়, তাদের দিল্লির বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হয়, যা মিয়ানমারের খুব কাছাকাছি। পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছার পর, তাদের ইউএনএইচসিআর-এর পরিচয়পত্র, অর্থ ও মালপত্র কেড়ে নেওয়া হয় এবং চোখ বাঁধা ও হাত বাঁধা অবস্থায় একটি নৌবাহিনীর জাহাজে তোলা হয়। জাহাজে তাদের আবারও মারধর করা হয় এবং পাহেলগাম হামলার সঙ্গে মিথ্যা যোগসূত্রের অভিযোগ তোলা হয়। পরে তাদের বলা হয়, চাইলে ইন্দোনেশিয়ায় যেতে পারে, মিয়ানমারে নয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত, তাদের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। তারাই নিজেরাই সাঁতরে মিয়ানমারের উপকূলে পৌঁছান।