উষ্ণ পৃথিবীর আশঙ্কা: ২০২৫ থেকে ২০২৯ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ চিত্র

জাতিসংঘের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক এক তথ্য উঠে এসেছে—২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত একটি বছর ২০২৪ সালের রেকর্ড উষ্ণতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। ২০২৩ ও ২০২৪ সাল ছিল ইতিহাসের রেকর্ড গড়া সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এই ধারাবাহিকতা আগামী দিনগুলোতেও বজায় থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ডব্লিউএমও-এর উপ-মহাসচিব কো ব্যারেট জানান, টানা ১০টি বছর ছিল উষ্ণতম। দুঃখজনকভাবে, আগামী বছরগুলোর জন্য কোনো স্বস্তির আভাস নেই, বরং তা মানুষের জীবন, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং গোটা পৃথিবীর ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সম্ভব হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে স্থির রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই প্রাক-শিল্প যুগ হিসেবে ধরা হয় ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কে, যখন কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার ব্যাপক হারে শুরু হয়নি। কিন্তু এসব জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। অনেক জলবায়ুবিদ মনে করছেন, ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি লক্ষ্য অর্জন এখন আর সম্ভব নয়, কারণ এখনো কার্বন নিঃসরণ কমানো দূরে থাক, বরং তা দিন দিন বাড়ছে।
ডব্লিউএমও এবং যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহযোগিতায় তৈরি পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি বেশি হতে পারে। আইরিশ ক্লাইমেট অ্যানালাইসিস ইউনিটের পরিচালক পিটার থর্নের মতে, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যেই এই আশঙ্কা শতভাগ বাস্তবে পরিণত হতে পারে। ডব্লিউএমও-এর জলবায়ু বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার হিউইট জানান, ২০১৫ থেকে ২০৩৪ পর্যন্ত ২০ বছরের গড় উষ্ণতা ১ দশমিক ৪৪ ডিগ্রি হতে পারে। ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা কোপারনিকাস বলছে, বর্তমানে গড় উষ্ণতা ১ দশমিক ৩৯ ডিগ্রি, এবং ২০২৯ সালের আগেই এটি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ছুঁয়ে যেতে পারে। যদিও মাত্র ১ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে, তবুও আগামী পাঁচ বছরে অন্তত একটি বছর ২ ডিগ্রির বেশি উষ্ণ হতে পারে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএমও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, খরা, বরফ গলন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরও ভয়াবহভাবে বাড়িয়ে তুলছে। চলতি বছরেও বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের চরম আবহাওয়া। চীনে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে তা ৫২ ডিগ্রি এবং পাকিস্তানে তীব্র তাপপ্রবাহের পর প্রাণঘাতী ঝড় আঘাত হেনেছে। জলবায়ুবিদ ফ্রিডেরিকে ওটো জানান, আমরা ইতোমধ্যে বিপজ্জনক উষ্ণতায় পৌঁছে গেছি। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, আলজেরিয়া, ভারত, চীন ও ঘানায় প্রাণঘাতী বন্যা দেখা দিয়েছে, আর কানাডায় ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। তবু ২০২৫ সালেও কয়লা, তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা আমাদের নিঃস্বার্থভাবে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশেষত আর্কটিক অঞ্চলে উষ্ণতা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক দ্রুত বাড়ছে। ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে বারেন্টস সাগর, বেরিং সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের একটি উপসাগরে বরফের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ায় এবং সাহেল অঞ্চল, উত্তর ইউরোপ, আলাস্কা ও উত্তর সাইবেরিয়ায় গড়ের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে, বিপরীতে আমাজন অঞ্চলে গড়ের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের কোনো শঙ্কা নয়, এটি বর্তমান সময়ের বাস্তবতা। যদি দ্রুত কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বছর আরও বেশি উষ্ণ এবং ভয়াবহ হয়ে উঠবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আপনার মতামত লিখুন