গাজায় নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে এক লাখে, শিশু ও নারীর মৃত্যু অনুপাতে শীর্ষে

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যা এই সংকীর্ণ ভূখণ্ডটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ। শুক্রবার এমন তথ্য প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ।
এই হিসাব গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বঘোষিত নিহতের সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫৬,৩০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তবে হারেৎজ–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, সরাসরি বোমা হামলায় নিহত ছাড়াও বহু মানুষ পরোক্ষভাবে মারা গেছেন— যেমন অনাহার, ঠান্ডা এবং চিকিৎসার অভাবে। কারণ, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
দৈনিকটি আরও জানায়, অতীতে ইসরায়েলি মুখপাত্র ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে বলে সন্দেহ করতেন। কিন্তু এখন অনেক আন্তর্জাতিক গবেষক ও বিশ্লেষক এসব তথ্যকে গ্রহণযোগ্য হিসাব বলেই মনে করছেন। বরং বাস্তবতার তুলনায় এটিকে রক্ষণশীল হিসাব বলাও হতে পারে।
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অফ হোলোওয়ের অর্থনীতিবিদ ও যুদ্ধকালীন প্রাণহানির আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল স্প্যাগ্যাট গাজায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। এতে গাজার দুই হাজার পরিবারের প্রায় ১০,০০০ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ইসরায়েলি সহিংসতায় গাজায় আনুমানিক ৭৫,২০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যার অধিকাংশই ইসরায়েলি গোলাবারুদের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই শিশু (১৮ বছরের নিচে) এবং নারী। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অধিকাংশ যুদ্ধের তুলনায় ব্যতিক্রমী ও ভয়াবহ।
অধ্যাপক স্প্যাগ্যাট বলেন, গাজা যুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘাত হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। সিরিয়া, ইউক্রেন বা সুদানে নিহতের মোট সংখ্যা হয়তো বেশি, কিন্তু গাজার এই যুদ্ধ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর অনুপাতে সবার শীর্ষে।
তথ্য অনুযায়ী, গাজায় সহিংসভাবে নিহত শিশু ও নারীর অনুপাত অন্যান্য সাম্প্রতিক যুদ্ধের তুলনায় দ্বিগুণ বা তারও বেশি— যেখানে কসোভোতে ছিল ২০ শতাংশ, উত্তর ইথিওপিয়ায় ৯ শতাংশ, সিরিয়ায় ২০ শতাংশ এবং সুদানে ২৩ শতাংশ।
স্প্যাগ্যাট বলেন, “আমার ধারণা, গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছে। ২১ শতকের কোনো সংঘাতে এই অনুপাতে এত প্রাণহানি হয়েছে কিনা, আমি জানি না।”
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর অভিযান শুরু হয়। আন্তর্জাতিক মহল বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও ইসরায়েল তা উপেক্ষা করে। গত বছরের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
এছাড়া, গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)–এ একটি মামলা চলমান রয়েছে।
ইসরায়েলি আগ্রাসনের এ ভয়াবহ মানবিক চিত্র শুধু ফিলিস্তিনের জন্য নয়, সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য এক নিষ্ঠুর কলঙ্ক হিসেবে ইতিহাসে রয়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন