সরকারি সেবায় দুর্নীতি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় নাগরিক মতামত প্রকাশ করল বিবিএস

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশের নাগরিকদের সরকারি সেবা, দুর্নীতি, নিরাপত্তাবোধ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মতামতের একটি বিস্তৃত চিত্র। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেলে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি সেবায় ৩১.৬৭ শতাংশ নাগরিক ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩৮.৬২% এবং নারীদের ক্ষেত্রে ২২.৭১%। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে বিআরটিএ (৬৩.২৯%), আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী (৬১.৯৪%), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫%) ও ভূমি অফিস (৫৪.৯২%)।
জরিপ অনুযায়ী, সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরা করতে ৮৪.৮১% নাগরিক নিজেকে নিরাপদ মনে করেন। তবে এখানে লিঙ্গভিত্তিক স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে— পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৮৯.৫৩% হলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা ৮০.৬৭%। শহরে ৮৩.৭৫% এবং গ্রামে ৮৫.৩০% নাগরিক নিজ এলাকায় নিরাপদ বোধ করেন। আর সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতে নিরাপত্তাবোধের হার ৯২.৫৪%, যেখানে নারীদের মধ্যে এই হার ৯১.৮২% এবং পুরুষদের মধ্যে ৯৩.৩৫%।
সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মতামত প্রকাশে মাত্র ২৭.২৪% নাগরিক নিজেদের স্বাধীন মনে করেন। এই অনুপাতে পুরুষদের সংখ্যা ৩১.৮৬%, যেখানে নারীদের সংখ্যা ২৩.০২%— যা একটি স্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নির্দেশ করে। অন্যদিকে, মাত্র ২১.৯৯% নাগরিক বিশ্বাস করেন যে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে ৪৭.১২% নাগরিক অন্তত একবার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৮২.৭২% নাগরিক সেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯.৩৪% সেবার ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। তবে স্বাস্থ্যসেবার মান, স্বাস্থ্যকর্মীদের সময় প্রদান এবং আচরণে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬৫.০৭%, ৬৩.১৩% ও ৬৩.১৯%, যা আরও উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে ৪০.৯৩% নাগরিক জানিয়েছেন যে তাদের অন্তত একটি শিশু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। প্রাথমিক স্তরে ৯৬.৪৬% নাগরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহজ প্রবেশাধিকারের কথা বলেন এবং ৯২.৬৬% শিক্ষাব্যয়কে সামর্থ্যের মধ্যে মনে করেন। মাধ্যমিকে এই হার কিছুটা কমলেও এখনো যথেষ্ট ইতিবাচক— যথাক্রমে ৮২.২০% ও ৮০.৮৬%। মানসম্পন্ন শিক্ষার বিষয়ে প্রাথমিক স্তরে সন্তুষ্টির হার ৬৭.৯৩% এবং মাধ্যমিকে ৭১.৮৬%।
পরিচয়পত্র বা নাগরিক নিবন্ধনের মতো অন্যান্য সরকারি সেবার ক্ষেত্রে ৭৮.১২% নাগরিক প্রাপ্তিযোগ্যতায় সন্তুষ্ট এবং ৮৬.২৮% ব্যয়কে সামর্থ্যের মধ্যে মনে করেন। তবে কার্যকর সেবা প্রক্রিয়া, সময়মতো সেবা এবং সমআচরণে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬২.৬০%, ৫১.২৮% এবং ৫৬.২৬%— যা মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, গত দুই বছরে ১৬.১৬% নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধে জড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৩.৬০% বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পেরেছেন। এদের মধ্যে ৪১.৩৪% আনুষ্ঠানিক এবং ৬৮.৯৬% অনানুষ্ঠানিক পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন।
বৈষম্য ও হয়রানির বিষয়ে জরিপে দেখা যায়, গত এক বছরে ১৯.৩১% নাগরিক কোনো না কোনো বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। শহরাঞ্চলে এই হার ২২.০১% এবং গ্রামাঞ্চলে ১৮.০৭%। আর্থ-সামাজিক ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। বৈষম্যের স্থান হিসেবে পরিবার, গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থান এবং কর্মস্থলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে মাত্র ৫.৩৫% ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতা কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করেছেন।
জাতিসংঘের গ্লোবাল কাস্টোডিয়ান প্রতিষ্ঠানসমূহ UNDP, UNODC ও OHCHR-এর নির্দেশনায় এ জরিপ পরিচালিত হয়। দেশের ৬৪টি জেলার ১,৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ৪৫,৮৮৮টি খানার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত এই ফলাফল জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি ১৬-এর ছয়টি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিবিএস জানিয়েছে। এই তথ্য দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার ও প্রশাসনিক কাঠামোয় নীতিনির্ধারণে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে।
আপনার মতামত লিখুন