ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শেষে যুদ্ধবিরতি, তবে উত্তেজনা ও ফতোয়া জারি অব্যাহত

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানা ১৩ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষ হলেও উত্তেজনার পারদ এখনো চরমে। সামরিক অভিযান থেমে গেলেও দুই পক্ষের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও হুমকি-ধমকির লড়াই চলছে অব্যাহতভাবে। এরই মধ্যে গাজায় হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ধর্মীয় ফতোয়া জারি করেছেন ইরানের প্রভাবশালী শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজী।
ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা মেহের নিউজ জানায়, ফতোয়ায় ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে ‘আল্লাহর শত্রু’ আখ্যা দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি ঘোষণা দেন, কোনো ব্যক্তি বা সরকার যদি ইসলামি নেতাকে হুমকি দেয়, তবে তাকেও আল্লাহর শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে শত্রুদের প্রতি কোনো সহানুভূতি বা সহযোগিতা করা হারাম বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
আয়াতুল্লাহ শিরাজী আরও বলেন, যদি কোনো মুসলমান নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পথে নির্যাতিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সে সৃষ্টিকর্তার রাস্তায় সংগ্রামরত একজন যোদ্ধার মর্যাদা পাবে। তিনি দোয়া করেন, ইসলামি সমাজ যেন শত্রুদের অশুভ কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা পায়।
এদিকে ইরানের আরেক শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ নুরি হামেদানি বলেন, শিয়া মারজা ও ইসলামি উম্মাহর নেতার ওপর আক্রমণ পুরো ইসলামের স্তম্ভ ও মুসলমানদের জীবনের ওপর আঘাত। তিনি হুঁশিয়ার করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এমন কর্মকাণ্ডের কঠোর জবাব দেওয়া হবে। হামেদানি আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইতিহাস রক্তপাত, লুণ্ঠন ও হত্যার মতো অপরাধে পরিপূর্ণ। তিনি ইহুদিবাদী সরকারের বর্বরতা ও ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন।
এর আগে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ বলেছিলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের, কিন্তু সুযোগ না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। একই সময়ে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইঙ্গিত দেন, খামেনির অবস্থান তাদের জানা এবং ইচ্ছা করলেই তাকে হত্যা করা সম্ভব।
এই উত্তেজনার সূচনা ঘটে ১৩ জুন রাতে, যখন কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইসরায়েল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ চালিয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানসহ একাধিক সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি, জ্যেষ্ঠ কমান্ডার গোলাম আলি রশিদ এবং দশজন পারমাণবিক বিজ্ঞানীসহ ৬০০ জনের বেশি নিহত হন।
জবাবে ইরান ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩’ চালু করে, যেখানে তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানে। এতে ইসরায়েল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যদিও হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
এরপর ২১ জুন রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালায়। জবাবে ২৩ জুন রাতে ইরান কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালায়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইরান ও ইসরায়েল একটি ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে’ সম্মত হয়েছে।
তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তখনই ট্রাম্পের দাবিকে অস্বীকার করেন। পরদিন, ২৪ জুন দুপুরে যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েলের গণমাধ্যমে। পরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এবং ইরানের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
যুদ্ধ থামলেও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তেজনা এখনো থামেনি। বরং এই সংঘাত আরও গভীর আকার ধারণ করছে ধর্মীয় ফতোয়া ও পাল্টাপাল্টি হুমকির মাধ্যমে। এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বে নতুন করে অস্থিরতা তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন