স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করলেন

ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ৯:২০ পূর্বাহ্ণ
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ দুর্নীতির দায়ে  পদত্যাগ করলেন

অবশেষে পদত্যাগ করেছেন বৃটেনের বহুল বিতর্কিত সিটি মিনিস্টার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বিরোধী দায়িত্বে থাকা টিউলিপ সিদ্দিক। প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ও তার দাবি, এথিকস এডভাইজার বা নিরপেক্ষ তদন্তকারী স্যার লরি ম্যাগনাস তদন্তে দেখতে পেয়েছেন যে- তিনি মন্ত্রিত্বের কোনো আইন লঙ্ঘন করেননি। টিউলিপ বলেছেন, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে- ট্রেজারিতে ইকোনমিক সেক্রেটারি (অর্থ বিষয়ক মন্ত্রী) হিসেবে আমার দায়িত্ব অব্যাহত রাখা সরকারি কাজে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করার পর তার পদে নতুন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এমপি এমা রেনল্ডস’কে।

টেলিগ্রাফ পত্রিকা বলছে- দুর্নীতি নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে ট্রেজারি মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। তার খালা ও বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সম্পর্ক, লন্ডনে শেখ হাসিনার মিত্রদের উপহার হিসেবে দেয়া প্রোপার্টি ইস্যুতে ক্রমশ চাপ বাড়ছিল তার ওপর। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এথিকস বিষয়ক উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারকে এক চিঠিতে লরি ম্যাগনাস লিখেছেন, তিনি মনে করেন যে তার উচিত টিউলিপের চলমান দায়িত্বগুলোর বিষয়ে বিবেচনা করা, যদিও তিনি মনে করেন- টিউলিপ মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। তবে একই দিন কিয়ের স্টারমারকে নিজে একটি চিঠি লিখেছেন টিউলিপ। তাতে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পার্লামেন্টের সামনের সারিতে বসে তার দায়িত্ব অব্যাহত রাখা হতে পারে সরকারের কাজের জন্য বিভ্রান্তিকর। চিঠিতে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মিস সিদ্দিক। তিনি বলেছেন, আপনি জানেন যে- আমার অনুরোধে অভিযোগের বিষয়ে গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করেছেন স্যার লরি। তিনি নিশ্চিত করেছেন, আমি মন্ত্রিত্বের বিধি ভঙ্গ করিনি। টিউলিপ আরও বলেছেন, আমার পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়টি সরকারি রেকর্ডের ব্যাপার। যখন আমি মন্ত্রী হই, সে সময় আমার সম্পর্ক এবং সরকারের প্রাইভেট ইন্টারেস্ট সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দিয়েছি। টিউলিপ দাবি করেছেন, তিনি পূর্ণাঙ্গ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সরকারে থাকার সময় তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার আনুগত্য এই লেবার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আছে এবং সবসময় থাকবে। সরকার যে জাতীয় রূপান্তরকরণ ও পরিবর্তন শুরু করেছে সেই কর্মসূচির প্রতিও আনুগত্য থাকবে। তাই আমি মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও বোন শেখ রেহানার মেয়ে। শেখ হাসিনার পতনের পর টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কেলেঙ্কারির খবর বোমার মতো ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ওঠে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একজন আওয়ামী লীগ নেতা ও ডেভেলপার আবদুল মোতালিফের কাছ থেকে উপহার হিসেবে বৃটেনের কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট নিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। তার বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তির নামে আরও একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন আইনজীবী মঈন গণি। প্রকারান্তরে সেই ফ্ল্যাটও টিউলিপকে উপহার দেয়া হয়েছে। কারণ, রূপন্তি ওই ফ্ল্যাট টিউলিপকে পরিবার সহ ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এসব বিষয় গোপন করেছেন টিউলিপ। শুধু তা-ই নয়, তিনি শেখ হাসিনার ভাগ্নি হওয়ার পরও তার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক আলোচনা কখনো করেননি বলে দাবি করেন। কিন্তু তার ব্লগ ফাঁস করে দিয়েছে মিডিয়া। তাতে দেখা যায়, তিনি শেখ হাসিনার জয়ে গর্ব প্রকাশ করেছেন। তার প্রচারণায় ছিলেন তিনি। এর বাইরে রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা, টিউলিপ, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রমুখ ৫০০ কোটি ডলার মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে বাংলাদেশে দুদক তদন্ত করছে। তদন্ত চলছে বৃটেনে। কিন্তু অভিযোগ উঠার পর দীর্ঘ সময় তা অস্বীকার করে মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকেন টিউলিপ। তার পদত্যাগ দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা, বিরোধী কনজারভেটিভ দলের কিছু এমপি। কিন্তু টিউলিপ তার খালা শেখ হাসিনার মতো ক্ষমতা ধরে রাখেন। এ নিয়েও অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার হলেন টিউলিপের ক্ষমতার খুঁটি। টিউলিপ সিদ্দিক অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তিনি নিরপেক্ষ তদন্তকারী লরা ম্যাগনাসের কাছে এই আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। টিউলিপের বিরুদ্ধে যখন তীব্র চাপ, প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতিতে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ জোরালো হতে থাকে, বৃটেনের রাজনীতি উত্তাল হতে শুরু করে, তখন বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী পিটার কিলি বলেন, নিরপেক্ষ তদন্তকারী যদি দেখেন মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন টিউলিপ, তাহলে তিনি সরকারি পদে থাকতে পারবেন না। কয়েকদিন ধরে এই বিতর্ক বৃটেনের প্রথম সারির সব মিডিয়ার প্রথম পৃষ্ঠায়। তারা গুরুত্ব দিয়ে টিউলিপের দুর্নীতি ও সে সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করতে থাকে। কোনো কোনো মিডিয়া প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদ শিরোনাম করে। এসব রিপোর্টে টিউলিপের খালা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত করে। এমন বিতর্ক এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি যখন টিউলিপের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখন বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার পদত্যাগের খবর দেয় বিবিসি। ওদিকে বর্তমান পার্লামেন্টের পুরো মেয়াদে চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে প্রথমবার এমপিদের মুখোমুখি হতে হয়েছে চ্যান্সেলর র‌্যাচেল রিভসকে।

মঙ্গলবার স্যার লরি ম্যাগনাস বলেছেন, এটা দুঃখজনক যে মিস সিদ্দিক বাংলাদেশি সাবেক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে সুনামের ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না। তিনি আরও বলেছেন, যে দুটি প্রোপার্টি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার ডকুমেন্ট পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। এই ঘটনাটি ঘটেছে কমপক্ষে ২০ বছর আগে। টিউলিপ সিদ্দিক ও তার বোনকে ২০০৪ সালে এবং ২০০৯ সালে ওই দুটি ফ্ল্যাট উপহার দেয়া হয়েছে। ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ উল্লেখযোগ্য ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য সরবরাহ করেছেন। তাতে দেখিয়েছেন যে, তার তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে। তবে এটা ‘কনক্লুসিভ’ ছিল না। এসব লেনদেনের অভিযোগের গুরুত্বের প্রেক্ষিতে এটা দুঃখজনক যে, কনক্লুসিভ তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।  স্যার লরি আরও বলেন, মিস সিদ্দিক অজান্তেই কিংস ক্রসে তাকে একটি ফ্ল্যাট উপহার হিসেবে দিয়েছে, সেই দাতার পরিচয় সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন ২০২২ সালের জিজ্ঞাসাবাদে।
‘কনজারভেটিভদের মতোই খারাপ লেবার সরকার’

টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে কিয়ের স্টারমার দু’জন মন্ত্রী হারালেন। এক দশক আগে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ স্বীকার করে নেয়ার পর গত মাসে পদত্যাগ করেন পরিবহনমন্ত্রী লুইস হাই। তারপর দ্বিতীয় মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করলেন টিউলিপ। ক্ষমতায় আসার প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই অনেক স্ক্যান্ডাল বা কেলেঙ্কারি জেঁকে ধরেছে লেবার পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকারকে। এর ফলে স্যার কিয়ের স্টারমার ঐতিহাসিকভাবে একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অজনপ্রিয়তার নিম্নতম স্থানে পৌঁছে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীত্বের ১০০ দিনের আগেই তিনি বরখাস্ত করেছেন নিজের চিফ অব স্টাফ সু গ্রে’কে। লেবার দলের দাতা লর্ড আলির কাছ থেকে অবাধে অর্থ এবং পোশাক নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এর পরিমাণ হাজার হাজার পাউন্ড। এমন অবস্থায় রিফর্ম ইউকে এবং লিবারেল ডেমোক্রেটরা লেবার পার্টিকে বিগত কনজারভেটিভ সরকারের মতোই খারাপ হিসেবে অভিহিত করেছে। রিফর্মের একজন মুখপাত্র বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের মধ্যেই পদত্যাগ করতে হয়েছে কিয়ের স্টারমারের দুর্নীতি বিরোধী মন্ত্রীকে। লিবারেল ডেমোক্রেট দলের কেবিনেট অফিসের মুখপাত্র সরাহ ওলনি বলেন, কনজারভেটিভ দলের বছরের পর বছর ধরে কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির পর জনগণ এই সরকারের কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করেছিল। কনজারভেটিভ দলের কেমি ব্যাডেনচ বলেন, সপ্তাহান্তে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে- দুর্নীতি বিরোধী মন্ত্রীর পদ পুরোপুরি অক্ষম হয়ে পড়েছে। তবু স্যার কিয়ের স্টারমার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সুরক্ষিত রাখতে বিচলিত হন এবং বিলম্ব করেন। এখন পর্যন্ত টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এতে টিউলিপের পদত্যাগে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আসলে দুর্বল নেতৃত্ব থেকে তৈরি হন একজন দুর্বল প্রধানমন্ত্রী।